#শরিয়তের_দৃষ্টিতে_গানবাজনা"
মুফতী সোহাইল হোসাইন
প্রথম পর্ব
শয়তান যেসব মন্দকে সুশোভিত ও মনোরম করে উপস্থাপন করে, গানবাজনা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গান-বাজনা শ্রবণ করা এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হারাম,
তা কুরআন- সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। এবং এর ওপর উম্মাহর ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১) কুরআন হতে দলীল
ক) কুরআনের প্রথম দলীল
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِى لَهُوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَبِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
'একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।[১]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, "এ আয়াতে 'অবান্তর কথাবার্তা' )لَهُوَ الْحَدِيثِ বলে গান-বাজনা ও অন্যান্য মন্দকে বোঝানো হয়েছে। ( ২)
وَكَذَا قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ، وَجَابِرٌ، وعِكْرِمة، وَسَعِيدُ بْنُ جُبَيْر، وَمُجَاهِدٌ، وَمَكْحُولٌ، وَعَمْرُو بْنُ شُعَيْبٍ، وَعَلِيُّ بْنُ بَذيمة..
এমনিভাবে জাবির, ইকরিমা, সাঈদ ইবনু জুবাইর, মুজাহিদ, মাকহুল, আমর ইবনু শুআইব এবং আলি ইবনু নাদীমা (রহিমাহুমুল্লাহ) থেকেও এই একই ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে।
وَقَالَ الْحَسَنُ الْبَصْرِيُّ: أُنْزِلَتْ هذه الآية: ﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ﴾ فِي الْغِنَاءِ وَالْمَزَامِيرِ
হাসান বসরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়েছে।( ৩)
﴿لَهْوَ الْحَدِيثِ﴾ أي: الأحاديث الملهية للقلوب، الصادَّة لها عن أجلِّ مطلوب. فدخل في هذا كل كلام محرم، وكل لغو، وباطل، وهذيان من الأقوال المرغبة في الكفر، والفسوق، والعصيان، ومن أقوال الرادين على الحق، المجادلين بالباطل ليدحضوا به الحق، ومن غيبة، ونميمة، وكذب، وشتم، وسب، ومن غناء ومزامير شيطان،
আবদুর রহমান সা'দি (রহিমাহুল্লাহ) উল্লেখিত শব্দের ব্যাখ্যায় যাবতীয় অশ্লীল কাজকর্ম, অনর্থক কথাবার্তা, গীবত, চোগলখুরী, গালি-গালাজ, মিথ্যা, কুফর, ফিসক, পাপাচার, অবৈধ খেলাধুলা, গান-বাজনা ও সব রকমের বাদ্যযন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।[৪]
ইবনুল কাইয়িম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, "সাহাবি ও তাবিয়িদের ব্যাখ্যা থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এই আয়াতে 'অবান্তর কথাবার্তা' বলে গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে।"
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও ইবনু উমর (রদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বিশুদ্ধ সনদে এই ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে।
আবুস সাহবা (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'আমি এই আয়াত সম্পর্কে ইবনু মাসউদ (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, "আল্লাহর কসম করে বলছি, এর মাধ্যমে কেবলমাত্র গান-বাজনাকেই বোঝানো হয়েছে।" কথাটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। ('৫)
সুতরাং,
আপনারা চারপাশে চোখ মেলে তাকান, কী দেখতে পাচ্ছেন?
কে যিনা-ব্যভিচারের পথ তৈরি করে দেয়? ইসলাম থেকে দূরে সরায়?
গান-বাজনা..
এটা অন্তরে নিফাকের বীজ বপন করে, শিরকের বীজ বপন করে। মানুষ যখন গান-বাজনার প্রতি আগ্রহী হয়,
আসক্ত হয়, তখন এটা অন্তরের রোগে পরিণত হয়।
একজন মানুষের গান-বাজনার প্রতি যত বেশি আগ্রহ সৃষ্টি হয়, সে কুরআন-সুন্নাহ থেকে তত বেশি দূরে সরে যায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, '... এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শান্তি অর্থাৎ যারা কুরআনের পরিবর্তে গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মেতে ওঠে। (৬)
খ) কুরআনের দ্বিতীয় দলীল
আল্লাহ তাআলা বলেন,
قال اذهب فمن تبعك مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزاؤُكُمْ جَزَاءً مُوْفُورًا وَاسْتَغْزِرُ مَن استطعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأُجْلِبُ عَلَيْهِم بِخَيْلِك وَرَجِلِكَ وَشَارِكَهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدُهُمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
'আল্লাহ (শয়তানকে) বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও। এদের মধ্য থেকে যারাই তোমার অনুসরণ করবে, তুমি-সহ তাদের সবার জন্য জাহান্নামই হবে পূর্ণ প্রতিদান। তুমি যাকে যাকে পারো তোমার আওয়াজের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করো। তাদের ওপর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালাও। ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে তাদের সাথে শরীক হয়ে যাও। এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেলো। আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। (৭)
⁕ حدثنا أبو كريب، قال: ثنا ابن إدريس، عن ليث، عن مجاهد، في قوله ﴿وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ﴾ قال: باللهو والغناء.
মুজাহিদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, "এখানে ব্যবহৃত 'আওয়াজ' শব্দের দ্বারা বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য মন্দ বিষয়াদিকে বোঝানো হয়েছে।"( তাফসীরে তাবারী)
ইবনুল কাইয়িম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'যারা আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতাপূর্ণ কথা বলে এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে, যেমন: বাঁশি, নিষিদ্ধ জাতের দফ, ঢোল-তবলা ইত্যাদি এগুলো হলো শয়তানের আওয়াজ। [৯]
গ) কুরআনের তৃতীয় দলীল
আল্লাহ তাআলা বলেন,
أمين هَذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ وَأَنتُمْ سَمِدُونَ
'তা হলে কি এসব কথা শুনেই তোমরা বিস্ময় প্রকাশ করছ? হাসছ, কিন্তু কাঁদছ না? বরং তোমরা খেল-তামাশায় লিপ্ত রয়েছ!" (১০)
⁕ حدثنا محمد بن عبد الأعلى، قال: ثنا محمد بن ثور، عن معمر، عن قتادة، عن عكرمة، عن ابن عباس، قوله ﴿سَامِدُونَ﴾ قال: هو الغناء، كانوا إذا سمعوا القرآن تَغَنَّوا ولعبوا، وهي لغة أهل اليمن، قال اليماني: اسْمُد
ইবনু কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, "সুফইয়ান সাওরি (রহিমাহুল্লাহ)-এর পিতা ইবনু আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, '(সূরা নাজমের ৬১ নম্বর) আয়াতে ব্যবহৃত 'খেল-তামাশা' )شامِدُونَ( শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, গান-বাজনা। এটি ইয়ামানি শব্দ।
যেমন 'ইসমিদ লানা' ( اسمد لنا) এর অর্থ হলো, আমাদের জন্য গান গাও।"
ইকরিমা (রহিমাহুল্লাহ)-ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।[১১]
[১] সূরা লুকমান, আয়াত: ৬।
[২] তাফসীরে তাবারী খন্ড: , ২০ পৃষ্ঠা: ১২৭-১২৮।
[২] ইবনু কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম,
খন্ড: ৩পৃষ্ঠা: ৪৫১।
[৩] সা'দি, তাফসীর খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৫০।
[৪,৫] ইবনুল কাইয়্যিম, ইগাসাতুল লাহফান, খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ২৪০।
[৬] সূরা লুকমান, আয়াত: ৬।
[৭] সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৬৩-৬৪।
[৯] ইবনুল কাইয়্যিম, ইগাসাতুল লাহফান,
খন্ড : ১পৃষ্ঠা: ২৫৫-২৫৬।
[১০] সূরা নাজম, আয়াত: ৫৯-৬১।
[১১] ইবনু কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম,
খন্ড:৭ পৃষ্ঠা: ৪৬৮
বি : দ্র :
১.
এখানে শুধু কুরআনের দলিলগুলো দেয়া হলো। সামনের পর্বে হাদীস থেকে অগনিত দলিল দিবো।
অতঃপর ফতোয়ার কিতাব থেকে অসংখ্য দলিল দিবো।
ইন শা আল্লাহ্।
কোন খবইশ যেনো বলতেছে গান-বাজনা জায়েজ তার জন্য কিছু পোস্টমর্টেম করতেছি।।।।
২.
অসংখ্য সাহাবী,তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের কওল রয়েছে।
যেখানে তারা স্পষ্টভাবে গান-বাজনা হারাম বলেছেন।
সেখানে এই বিদআতিরা কিভাবে জায়েজ বলে
আমার বোধগম্য হয় না। সেটা সামনাসামনি হলেই বুঝতে পারবো।।।
ইন শা আল্লাহ্
(সেগুলো হাদিসের পর্বে উল্লেখ করবো।)
✍️
মুফতী সোহাইল হোসাইন
মুফতী ও মুহাদ্দিস
মজিববাগ বড় মাদ্রাসা, নারায়ণগঞ্জ
Comments